সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাহিত্য যেভাবে প্রতিরোধকে ভাষা দেয়

০ টি মন্তব্য 2 ভিউ 31 মিনিট পড়ুন
অ+অ-
রিসেট করুন

প্রতিনিধিঃ

মোঃ শাহিন
print news | সাহিত্য যেভাবে প্রতিরোধকে ভাষা দেয় | সমবানী
সাহিত্য কীভাবে কাজ করে? কীভাবেই–বা সাহিত্য জনতার মুখে প্রতিরোধের ভাষা দেয়? এসব প্রশ্নের তত্ত্বতালাশ করে শিল্প–সাহিত্যের চৌহদ্দিতে ফিরে দেখা।

নীরবতা মানেই কি ভাষাহীনতা? নাকি নীরবতারও ভাষা আছে? এই তর্ক পুরোনো, আবার এক অর্থে নতুনও। আজকের বাংলাদেশে বসে মনে হচ্ছে, সরবতা ও নীরবতার ভাষাকে বোঝা দরকার। এখন দেখতে পাচ্ছি, ভাষার জোয়ার বইছে। দেয়ালে, ফুটপাতে, রাস্তায়, ব্যারিকেডে ফুটে উঠছে নানা রঙের অক্ষর। যেন এক শতাব্দীর নীরবতা ভেঙে মানুষ কথা বলতে চাইছে। তাহলে মানুষ কি কথা বলেনি? নিশ্চয়ই বলেছে; কিন্তু বলার আগে গিলে ফেলতে হয়েছে একটি-দুটি শব্দ, লিখতে লিখতে ব্যাকস্পেস দিয়ে মুছে ফেলতে হয়েছে দুটি-তিনটি বাক্য। না-বলা ও না-লেখা কথাগুলো ঠাঁই নিয়েছে মনের অনন্ত গহ্বরে।

আমাদের মনে পড়বে জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর উপন্যাসের উইন্সটন স্মিথকে; সত্যের মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে করতে যে মিথ্যাকেই দাঁড় করিয়ে দিত ‘সত্য’ হিসেবে; কিন্তু ভেতরে–ভেতরে মর্মদহনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। পার্টি শাসনের বিপরীতে যেতে যেতে একসময় সে হয়ে ওঠে ‘চিন্তা-অপরাধী’, তার পেছনে ছুটতে থাকে ‘চিন্তা-পুলিশ’। ভিন্নমত দমনের রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতাকে আমরা দেখতে পাই মিলান কুন্ডেরা কিংবা ইসমাইল কাদারের উপন্যাসেও। তাঁরা দুজনই দেখিয়েছেন যে কর্তৃত্ববাদ কী করে হরণ করে নিয়ে যায় ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্ভাবনাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে গত দেড় দশকজুড়ে মানুষের ছায়ার সঙ্গে লেপটে ছিল চিন্তা-পুলিশ। ঘাড়ের কাছে এসে নিশ্বাস ফেলেছে কর্তৃত্ববাদ; গুম ও খুনের বহরে যুক্ত হয়েছে সারি সারি নাম। তারপর? কথারা ফুটেছে, মাঠ-ময়দানে বিস্ফোরিত হয়েছে শব্দ। সাহিত্যও এই কাজ করে দেয়; কখনো প্রত্যক্ষ, কখনোবা পরোক্ষ প্রণোদনায় পাঠক অথবা জনতার কাছে পৌঁছে দেয় প্রতিরোধের সুর। তার প্রমাণ মিলল সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় কবিদের কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন দ্রোহের উক্তি। দু-চার লাইনের ছোট্ট পরিসরের ভেতর গেঁথে দিয়েছেন এক দশকের ক্রোধ।

অবশ্য তারও একটি প্রস্তুতি পর্ব ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের আগে কবিরা অনেক কথাই বলেছেন প্রতীক বা রূপকের আড়ালে। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিকেও তাঁরা ব্যবহার করতেন রয়ে সয়ে। প্রচলিত ইতিহাস মেনে শব্দটির অর্থপরিধিতে কবি-লেখকেরা হিটলার কিংবা মুসোলিনির শাসনকে খোপবন্দী করতেন ঠিকই, কিন্তু একটু মনোযোগী হলেই দেখা যেত, ভীতিকর বাংলাদেশের কথাই প্রতীকায়িত হয়েছে। শাসকের তরফ থেকে বারবার বলা কথা ও ক্ষমতার প্রতিমাকে সূক্ষ্ম স্যাটায়ার করেছেন কোনো কোনো কবি। কেউ কেউ ‘অন্ধকার’ বলতে আর কিছু নয়, বিগত দেড় যুগের দুঃশাসনকেই বুঝিয়েছেন। কবিতার নিবিড় ভোক্তা না হলে সেসব লেখার অর্থ উদ্ধার করা খানিকটা কঠিনই ছিল।

সময় যখন বদলাল, জনতার সামাজিক সাহস যখন ব্যক্তির অস্তিত্বে শক্তি জোগাল, তখন কবিরা আর একান্তভাবে শিল্পের কাছে নতজানু হতে চাইলেন না। শ্লীল-অশ্লীল, শিল্প-অশিল্প—এ–জাতীয় ‘বাইনারি’গুলোই ভেঙে পড়ল; কারণ, মুখ্য হয়ে উঠল প্রতিরোধের স্বর ও সুর।

এ মুহূর্তে এমন একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে, যেখানে লেখক ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র ধারণাকে ছুড়ে ফেলেছেন; ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশে বহু বছর ধরে প্রচারিত এই ‘মাতৃমূর্তি’র ভাবকে নস্যাৎ করে দিয়ে, রূপক বানিয়ে লেখক দেখিয়েছিলেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ প্রকৃতপক্ষে রক্তখেকো ও হত্যাপ্রবণ। সত্য হলো, এসব লেখাও শাসকের দিকে আঙুল তুলেছে।

ভয়ের সংস্কৃতির চাপেই হোক অথবা শিল্পের প্রতি সমর্পিত থাকার কারণেই হোক, কবিরা কবিতাকে যথাসম্ভব ‘শিল্পোত্তীর্ণ’ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সময় যখন বদলাল, জনতার সামাজিক সাহস যখন ব্যক্তির অস্তিত্বে শক্তি জোগাল, তখন কবিরা আর একান্তভাবে শিল্পের কাছে নতজানু হতে চাইলেন না। শ্লীল-অশ্লীল, শিল্প-অশিল্প—এ–জাতীয় ‘বাইনারি’গুলোই ভেঙে পড়ল; কারণ, মুখ্য হয়ে উঠল প্রতিরোধের স্বর ও সুর।

বিশ্বমঞ্চ খুঁজে আমরা সেই সুরকেই খুঁজে পাব। দেখতে পাব, ফিলিস্তিনি দুনিয়ায় জেগে উঠেছিলেন ঘাসান কানাফানি। নিপীড়িতের পক্ষে নিশান উড়িয়ে জানিয়েছিলেন, সাহিত্য হতে পারে প্রতিরোধের হাতিয়ার। সশস্ত্র যোদ্ধারা যেমন ক্যামোফ্লেজের আড়ালে লুকিয়ে গেরিলা সেজে যুদ্ধে নেমে যায়, একজন কবিকেও পরে নিতে হয় তেমন সাজ, শব্দবোমা দিতে হয় গুঁড়িয়ে দিতে হয় প্রতিপক্ষের ভিত। ঘাসান কানাফানির হাতেই আমরা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি ‘প্রতিরোধের সাহিত্য তত্ত্ব’কে; বাস্তুচ্যুত এই লেখক সাহিত্যকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ সাহিত্য কেবলই ভাষা ও শিল্পত্বের কারুকার্যে পর্যবসিত হয় না; চাইলে সে বাড়তি কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারে। কেজো দুনিয়ার বাস্তব ভান্ডারে সে-ও হানা দিতে পারে।

সাহিত্য কি কাজের দুনিয়ার বাইরে থাকা কোনো স্বপ্নগাথা? সংস্কৃতি কি সত্তার আত্মনির্মিতির বিষয় নয়? সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ভাষ্যের দৌলতে এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মুক্তিসংগ্রামী আফ্রিকার এক তাত্ত্বিক, নেতা ও কবি এমিলকার কাবরাল। আফ্রিকার সাংস্কৃতিক সম্পদের তালিকায় তিনি প্রথমেই রেখেছেন মৌখিক ও লিখিত শিল্পের ঐতিহ্যকে। পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সংগীত ও নৃত্য। কাবরাল শিল্পবস্তুর সাংস্কৃতিক মূল্যকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। কেননা কাবরাল মনে করেন, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নির্মাণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। মূলত ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রেক্ষাপটে প্রতিরোধের তাৎপর্যকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

আফ্রিকার পটভূমিতে আরও একজনের কথা আমাদের মনে পড়বে; তিনি কাবরালের মতো রাজনৈতিক নেতা নন; কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। ঔপনিবেশিক নির্দয়তার বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন চিন্তার নতুন দৃশ্যপট। নগুগি ভেবেছিলেন আফ্রিকার নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও থিয়েটারের কথা। গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন নাট্য-আন্দোলন। ইংরেজি ভাষার আধিপত্যের সামনে তাঁকে তৈরি করে নিতে হয়েছিল নতুন এক নিজস্ব শিল্পভাষা। ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির সমালোচক হিসেবে নগুগি আমাদের জানিয়েছেন, ভাষা হলো সংস্কৃতির ধারক, সত্তার সঙ্গে সত্তার এবং সত্তার সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যস্থতার মাধ্যম; ভাষা মূলত মানুষের অস্তিত্বকেই গড়ে তোলে।

অস্তিত্ব যখন ধসে পড়তে চায়, তখন তৈরি করে নিতে হয় মজবুত কাঠামো। হয়তো তাই শান্তিকামী এক সন্ত কবিকেও লিখতে হয় জোরালো প্রতিবাদের কবিতা। নিকারাগুয়ার কবি এর্নেস্তো কার্দেনাল লিখলেন জিরো আওয়ার-এর মতো কবিতার বই। কবিতা ও ধর্মতত্ত্ব কীভাবে রাজনীতি ও বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তার উদাহরণ এর্নেস্তো কার্দেনাল। সন্ত ও বিপ্লবী—দুই অভিধায় চিহ্নিত কার্দেনাল জড়িয়েছিলেন নিকারাগুয়ার সান্দিনাস্তা বিপ্লবের সঙ্গে। অথচ তাঁর শুরুর দিককার কবিতার ভরকেন্দ্রে ছিল মায়াময় প্রেম। পরিপার্শ্ব বদলে দিয়েছিল কার্দেনালের ক্যাথলিক অনুভূতিঘেঁষা কবিতাকে।

খুব বেশি দূরে না যাই। আমাদের কাছাকাছি থাকা ‘ভূস্বর্গ’ কাশ্মীরের কথা ভাবি। বুলেট, বোমা, শূন্য মুঠোফোন নেটওয়ার্ক, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বিচ্ছিন্নতাবাদ, জঙ্গি তত্ত্ব ইত্যাদির আবরণে বারবার ছেয়ে ফেলা হয়েছে কাশ্মীরকে। দেখতে পাব, কাশ্মীরিদের লেখায়, আঁকায়, জবানে সাহিত্য তুলে দিয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা। গাজা বা ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে অথবা হয়েছে, তার সঙ্গে নিজেদের তুলনা দিয়েছেন কাশ্মীরি কবি-লেখকেরা। ‘এথনিং ক্লিনজিং’ বা জাতিনাশের ভয় তাঁদের গ্রাস করতে চেয়েছে; তবু তাঁরা রুখে দাঁড়ানোর উচ্চারণ থেকে সরে যাননি। শিল্প–সাহিত্যের রংচঙে ভাষার মোড়কে তাঁরা গাইতে চান ‘কাশ্মীরিয়াতে’র বয়ান, ভাবতে চান ঐক্য ও সহাবস্থানের কথা—দূর অতীতে হিন্দু ও মুসলমান মিশে ছিল ইতিহাসের একই পাটাতনে, আর সেটিই হলো ‘কাশ্মীরিয়াতে’র স্বভাব।

ফেরা যাক বাংলায়। যে কথা আগে কেউ বলেননি, সে কথাই বলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীন রাখতে নারাজ তিনি, চান পূর্ণ স্বাধীনতা। ১৯৪২ সালে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পরও নজরুলের ভাষা ছিল সরব। কে তাঁর ভাষাকে বহন করেছে? এক শব্দে ‘বাঙালি’, আরেকটু প্রসারিতভাবে বললে ‘পূর্ব বাংলার বাঙালি’। এ অঞ্চলের প্রতিটি জাতীয় আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে প্রতিরোধের ভাষাসমেত হাজির হয়েছেন নজরুল। তাঁর জৈব শরীর যখন নীরব, তখন কথা বলেছে তাঁর সাহিত্য। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানেও তারুণ্যকে দ্রোহের আগুনে পুড়িয়ে শাণিত করেছে নজরুলের কবিতা ও গান।

ভেবে অবাক হতে হয়, বাঙালির ‘নির্জনতম’ কবি জীবনানন্দও বদলে নিচ্ছিলেন কবিতার আধার ও আধেয়কে; স্থান পাচ্ছিল যুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্রাজ্যবাদ অথবা রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘সভ্যতার সংকট’। তবে তা নজরুলের মতো করে উচ্চ স্বরে নয়, দিশাহীন বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন হয়ে; সময়কে উপেক্ষা করে নয়, বুঝেশুনে জীবনানন্দকেও বলতে হয়েছিল ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ’-এর কথা; উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন তিনি। তাঁর কবিতায় চলমান সময়ের অভিক্ষেপ দেখে সে সময় ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু তাতে কী! নির্জনতম কবির রূপসী বাংলা স্থান পেয়ে গেছে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সাংস্কৃতিক প্রতীকসমূহে। ১৯৫৭ সালে রূপসী বাংলা প্রকাশিত হওয়ার এক দশকের মধ্যে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা বইটিতে খুঁজে পেয়েছিলেন আবহমান বাংলার রূপ। প্রশ্ন হলো, জীবনানন্দ কি জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্যে বইটি লিখেছিলেন? মোটেও তা নয়। কিন্তু বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে রূপসী বাংলায় জাতীয় ইতিহাস ও প্রতিরোধের নকশা খুঁজে পেয়েছে। এই বইও বছরের পর বছর প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে কাজ করে গেছে নিভৃতে।

চোখ ফেলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাঙালি জাতি, সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার বাইরেও যে এ দেশে অপরাপর জাতি, সংস্কৃতি ও ভাষা আছে, এই সত্যকে রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রায় শূন্য করে ফেলা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙালিকেন্দ্রিকতাকে একমুখী সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ফলে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আধিপত্যের চাপে পড়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরি, সাঁওতাল, গারো, কোচ, হাজং প্রভৃতি জাতি ও ভাষার লেখক। এ কারণে একজন মৃত্তিকা চাকমা, কবিতা চাকমা, রণজিৎ সিংহ, শোভা ত্রিপুরা, সঞ্জীব দ্রংকে মনে রাখা হয় না। আর তাই অপরাপর ভাষাভাষীর কণ্ঠেও শোনা গেছে সেই স্বর, যা বলতে চায়, ‘রাষ্ট্র, জাতি ও সংস্কৃতির অংশীদার হিসেবে আমরাও অস্তিত্ববান।’ এই অভ্যুত্থানের দিনগুলোয় দেয়ালচিত্রে লেখা কথাগুলো জানান দিয়েছে বহুজাতিক রাষ্ট্রের ধারণাকে। এ কারণে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল পাহাড়ি জনপদ ও কল্পনা চাকমার নাম।

অনেক ক্ষেত্রেই উর্দু ভাষাকে ভাবা হয় বাংলার প্রতিপক্ষ হিসেবে। অথচ বাংলা অঞ্চলে উর্দুর অবস্থান কেবলই দেশভাগ–পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠেনি। একটি স্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলাদেশে উর্দুচর্চার প্রাচীন ইতিহাস আছে। এর ধারাবাহিকতায় একজন উর্দুভাষী কবি-লেখক নিজের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বিদ্যমানতাকে হাজির করতে চাইতেই পারেন তাঁর সাহিত্যসূত্রে। তখন তাঁর প্রকাশ-তৎপরতাকে সন্দেহ করা চলে না কিংবা প্রকাশের ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করা চলে না। বহু যুগ আগে ভ্লাদিমির লেনিন তো বলেই গেছেন, প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। ইতিহাস প্রমাণ দেয়, সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার অভিযানে ভাষা ও সাহিত্য শামিল হয়েছে। বাংলা অঞ্চলে ‘জাতীয় সাহিত্য’ গড়ে তোলার উদ্যোগগুলোয়ও কি অধিকার প্রতিষ্ঠার আবেগ কাজ করেনি?

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সাহিত্যের এই যোগসূত্রের দৃষ্টান্তমালাকে দীর্ঘ না করে বরং প্রশ্ন তোলা যায়, সাহিত্য কীভাবে জনতার মুখে প্রতিরোধের ভাষা দেয়? এ রকম প্রশ্নের বহুরৈখিক কার্যকারণনির্ভর উত্তর নিশ্চয়ই আছে। তবে একটি কারণ সম্ভবত এই যে সাহিত্য মানুষের অবচেতনে থাকা অপ্রকাশিত দ্রোহকে উসকে দেয়, ‘সেন্সরশিপ’-এর নিষেধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে বলে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে সাহিত্যের এই সক্রিয়তাকে আমরা দেখেছি। অবশ্য এই দাবি করছি না যে অগণন প্রতিবাদী সাহিত্যে ভরে উঠেছিল বাংলাদেশ। তবু যা কিছু হয়েছে, তা-ও তো মন্দ নয়। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাওয়া সমকালীন কবিদের শ্লোকগুলোর কথা মনে পড়বে আমাদের। চলতি বাস্তবতায় বিদ্যমান সাহিত্যই যে কেবল মানুষকে নাড়া দেয়, তা-ও নয়; পুরোনো ও লুপ্তপ্রায় রচনাও কখনো কখনো ইতিহাসের গতিমুখে শক্তি জোগায়।

পৃথিবীজুড়ে প্রায় প্রতিটি আধুনিক জাতি আত্মবিকাশ ও প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষা ও সাহিত্যকে বেছে নিয়েছে। আত্মপরিচয় নির্মাণের বিভিন্ন উপাদানকে জোড়া দিয়েছে সাহিত্য। অভ্যুত্থানের এই মৌসুমে সাহিত্যের দুয়ারে পুনর্বার ফিরে তাকানো দরকার। কেননা আমরা বাংলাদেশের জনগণ নতুন আত্মপরিচয় গঠনের দিকে ধাবমান। ভাষা ও সাহিত্য কি সেই খাতে নিজের সরব অবস্থানকে পরখ করে দেখবে না? আজকের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা ও সাহিত্যের নীরবতা থেকে সরবতায় রূপান্তরিত হওয়ার ইতিহাস কি বুঝে দেখব না আমরা?

আরও পড়ুন


Discover more from সমবানী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

থেকে আরও পড়ুন

একটি মন্তব্য করুন

আর্কাইভ
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১  

এই ক্যাটাগরির আরো খবর

এই ওয়েবসাইটটি আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। আমরা ধরে নেব আপনি এটির সাথে ঠিক আছেন, তবে আপনি চাইলে অপ্ট-আউট করতে পারেন৷ গ্রহণ করুন আরও পড়ুন

Discover more from সমবানী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading